প্রকাশিত: ০৭/০৯/২০১৭ ৭:৪৬ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১:৫৭ পিএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা’র কথা তোলার ঘোষণা দিচ্ছে, তখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’র (এআরএসএ বা আরসা) হামলার আশঙ্কার তথ্য প্রচার করছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আরসার সদস্যসংখ্যা মাত্র ৫০০। ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযানের নামে দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে দেড় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে ভিটেমাটিছাড়া করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে মিয়ানমার।

এদিকে বাংলাদেশ গত ১২ দিনের মধ্যে গতকাল বুধবার চতুর্থবারের মতো ঢাকায় মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করে রাখাইন পরিস্থিতির ও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টের হাতে দেওয়া এই পত্রে অত্যন্ত কড়া ভাষায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ প্রশ্ন তুলেছে মিয়ানমারের সামরিক অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম খান চৌধুরী মিয়ানমারের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অং মিন্টকে এসংক্রান্ত একটি প্রতিবাদপত্র হস্তান্তর করেছেন। পত্রে বাংলাদেশ উত্তর রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা প্রশমনে মিয়ানমারের কাছে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানায়। এ ছাড়া মিয়ানমারের বাসিন্দাদের বাংলাদেশমুখী স্রোত ঠেকাতে অনতিবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে এবং এ ধরনের নজিরবিহীন জনস্রোতের প্রকৃত কারণ সমাধানে ঢাকা নেপিডোকে অনুরোধ করেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের বাসিন্দাদের বাংলাদেশে প্রবেশের নজিরবিহীন স্রোতের জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার মাত্রা বৃদ্ধি এবং প্রাণরক্ষায় বিপুলসংখ্যক বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে প্রবেশের বিষয়েও উদ্বেগ জানানো হয়েছে। সামরিক অভিযানের সময় মিয়ানমার তার বেসামরিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় যথার্থ ব্যবস্থা না নেওয়ায় বাংলাদেশ দুঃখ করে বলেছে, এর ফলেই বিপুলসংখ্যক মানুষ মরিয়া হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
বাংলাদেশ রাখাইন রাজ্যের নৃগোষ্ঠী, ধর্ম-নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের সব সদস্যের সুরক্ষায় মিয়ানমারের অনতিবিলম্বে ও যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছে, যাতে কোনো বেসামরিক ব্যক্তিই বাংলাদেশে মরিয়া হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য না হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ঢোকা মিয়ানমারের সব বাসিন্দাকে ফিরিয়ে নিতে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নিতেও ঢাকা আহ্বান জানিয়েছে। সীমান্তের কাছে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর মানববিধ্বংসী মাইন পেতে রাখার খবরেও বাংলাদেশ উদ্বেগ জানিয়েছে।

জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারের অন্তত এক লাখ ২৫ হাজার বাসিন্দা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং আরো এক লাখ বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় আছে। অতীতে বিভিন্ন সময় সামরিক অভিযান ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সময় থেকে মিয়ানমারের প্রায় চার লাখ বাসিন্দাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের জন্য নতুন করে আসা মিয়ানমারের বাসিন্দাদের অতিরিক্ত চাপ বহন করা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলেছে, কোনোভাবেই বাংলাদেশের রাখাইন রাজ্যের ধারাবাহিক সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার শিকার হওয়া উচিত হবে না।

বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হবে : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি, পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বাসিন্দাদের মধ্যে যারা আহত হয়ে এ দেশে এসেছে, তাদের চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে। তারা যেন এ দেশের মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যেতে না পারে সে জন্য বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে তাদের পরিচয় নিবন্ধন করে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রোহিঙ্গারা এ দেশে আসার পর দেশে অপরাধের হার বেড়েছে। সমস্যা আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলেই মনে করছে সরকার। এ কারণে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের যাবতীয় তথ্য রাখার জন্য গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রোহিঙ্গা সেল খোলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক-১ শাখা থেকে পরিচালিত হবে সেলটি। এ সেলে নিয়মিত খবরাখবর পাঠাবে কক্সবাজার এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজিবি, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিদিন কত রোহিঙ্গা আসছে, তাদের মধ্যে কতজন অসুস্থ, কতজন নারী, কতজন পুরুষ এসেছে সেসব তথ্য আসবে প্রতিনিয়ত। পরে এই তথ্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠক হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মিটিংয়ে অন্যান্য আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মানবিক সহায়তার দিকগুলোর দিকে দৃষ্টি রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। ’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আরো জানান, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে প্রত্যেক রোহিঙ্গার ১০ আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে। প্রয়োজনে চোখের ছবিও (আইরিশও) তোলা হবে। সরকারের সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। কিন্তু এর আগে যাতে তারা এ দেশে এসে অন্য কোথাও চলে গিয়ে বাংলাদেশি সেজে যেতে না পারে সে জন্যই এমন ব্যবস্থা বলে জানান তিনি। রোহিঙ্গাদের কেউ যদি অন্য কোথাও গিয়ে কোনো অপরাধ করে সে ক্ষেত্রে ধরা পড়লেও বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে জানা যাবে যে সে বাংলাদেশি নয়, রোহিঙ্গা। তাদের এর আওতায় আনতে পারলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য সুবিধা হবে। এ ছাড়া যদি কোনো রোহিঙ্গা দীর্ঘ মেয়াদেও এ দেশে থাকে সে ক্ষেত্রে তাকে নজরদারি করাও সহজ হবে। বায়োমেট্রিক নিবন্ধন হওয়ার পর তাদের মনেও অপরাধ করতে গিয়ে ভয় থাকবে।

ওই কর্মকর্তা আরো জানান, বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করা এখন অনেক সহজ হয়েছে। মোবাইল ফোনের সিম কেনার পর বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধন করা হয়ে থাকে। সুতরাং রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন করাও জটিল কোনো বিষয় নয়। তিনি আরো জানান, যদি তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর পর আবারও আসে, তাহলেও বায়োমেট্রিক পদ্ধতির কারণে ধরা পড়বে। নতুন ও পুরনো সব রোহিঙ্গারই বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করার পর একটি ডাটা বেইস তৈরি করবে সরকার।

‘গণহত্যা’ : দৃশ্যত রোহিঙ্গা মুসলমানদের পুরোপুরি মিয়ানমার ছাড়া করার নীতি গ্রহণ করেছে মিয়ানমার। অং সান সু চির তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারকে সামনে রেখে জাতিগত নিধন ও গণহত্যায় মেতেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। গত অক্টোবরেও মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের সময় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগ তদন্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ মিয়ানমারে ‘তদন্তদল’ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেও সেই দলের মুখোমুখি হওয়ার সৎসাহস দেখায়নি সু চির সরকার। গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার যে বেপরোয়া নির্মূল অভিযান শুরু করেছে তাকে আরো ভয়াবহ ও মানবতাবিরোধী বলছেন সেখান থেকে আসা রোহিঙ্গারা। পরিস্থিতি জানতে সেখানে সাংবাদিকসহ বিদেশিদের যেতে দিচ্ছে না মিয়ানমার।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি উপগ্রহ-চিত্র তুলে ধরে বলেছে, রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত একটি গ্রামেই সাত শরও বেশি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ধ্বংসলীলার মাত্রা আগে যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নিপীড়নকে বিশ্বের বিশ্লেষকদের অনেকে গণহত্যার মতো অপরাধ হিসেবেই দেখছেন। দাবি উঠেছে সু চির নোবেল পদ প্রত্যাহারেরও। সু চির বর্তমান ভূমিকার নিন্দায় ওয়াশিংটন পোস্ট সম্পাদকীয় ছেপেছে। প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিকটি বলেছে, “সু চি নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা পুনর্বার পাঠ করে দেখতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলা যেখানে থাকবে না কোনো বাস্তুহীন, ঘরহীন, আশাহীন মানুষ। সে বিশ্ব হবে সত্যিকারের এক অভয়ারণ্য, যার বাসিন্দাদের থাকবে শান্তিতে বসবাসের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা। ’ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিশ্বটা আজ মোটেই এ রকম নয়। ”

প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে কলামিস্ট জর্জ মনবিয়ট নিবন্ধ লিখেছেন ‘অং সান সু চির নোবেল পদক ছিনিয়ে নাও, তিনি এর যোগ্য নন’ শিরোনামে। তিনি লিখেন, ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘে গৃহীত ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ এ পাঁচটি অপরাধের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এর যেকোনো একটি যখন ‘কোনো জাতীয়, নৃতাত্ত্বিক, সম্প্রদায়বিশেষ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে করা হয়, তখন তা গণহত্যা বলে বিবেচিত হবে। অং সান সু চি দেশটির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণের পর রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করার সুস্পষ্ট এবং প্রায়শ প্রকাশ্য উদ্দেশ্য নিয়েই পাঁচ অপরাধের অন্তত চারটি কমবেশি নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাচ্ছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী। ’

বিখ্যাত সংবাদ সাময়িকী নিউজ উইক গতকালই ‘ইজ জেনোসাইড অকারিং এগেইনস্ট দ্য রোহিঙ্গা ইন মিয়ানমার’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে লন্ডনের মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম স্কাবাস বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারে যে আচরণ করা হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। সিমন-স্কট সেন্টার ফর প্রিভেনশন অ জেনোসাইড (যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান) এর প্রগ্রাম ম্যানেজার আন্দ্রিয়া জিটলম্যান বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠান ২০১৫ সালেই রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরণ গণহত্যার শামিল হয়ে থাকতে পারে বলে উদ্বেগ ব্যক্ত করে। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি গণহত্যা অপরাধের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব ২৬০ (৩) এর অধীনে গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা প্রতিরোধে সকল রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। এই গণহত্যার সংজ্ঞা শুধু ‘হত্যা’র মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে—এমন কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। গণহত্যার সংজ্ঞায় বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো—(ক) পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য তাদের সদস্যদের হত্যা বা নিশ্চিহ্নকরণ, (খ) তাদের নিশ্চিহ্ন করবার জন্য শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিসাধন, (গ) পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংসসাধনকল্পে এমন জীবননাশী অবস্থা সৃষ্টি করা যাতে তারা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, (ঘ) এমন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যাতে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর জীবন ধারণে শুধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিই নয়, তাদের জন্ম প্রতিরোধ করে জীবনের চাকাকে থামিয়ে দেওয়া এবং (ঙ) একটি জাতি বা গোষ্ঠীর শিশু সদস্যদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্মপরিচয় ও জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলা।

ধৈর্য হারাচ্ছে বিশ্ব সম্প্রদায় : আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে জানা যায়, রোহিঙ্গাদর প্রতি মিয়ানমারের আচরণ সারা বিশ্বেই শান্তিকামী জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস দুই সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে নজর রাখছেন এবং বিবৃতি দিচ্ছেন। তিনি নজিরবিহীনভাবে নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির কাছে চিঠি লিখে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছেন এবং এ নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। গত মঙ্গলবার রাতে তিনি নিউ ইয়র্কে সাংবাদিকদের বলেন, উত্তেজনা প্রশমন এবং বিষয়টির সামগ্রিক সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে আরো উদ্যোগী হয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে অনেকের প্রাণহানির কথাও উল্লেখ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, রোহিঙ্গাদের অমীমাংসিত সমস্যাটি দীর্ঘদিনের। এটি আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার একটি নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠছে।

ইউরোপের ২৮টি দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মগেরিনি গতকাল রাতে এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত ভয়াবহ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ২৫ আগস্টের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে চলমান অভিযানে সম্পৃক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব হলো সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন এবং নিরস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তিনি সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন পুরোপুরি মেনে চলার আহ্বান জানান। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে ফেদেরিকা মগেরিনি বলেন, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি অনতিবিলম্বে ও পূর্ণোদ্যমে সেই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়েছেন।

ইউএসএ টুডে পত্রিকায় গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অং সান সু চি নোবেল জয় করেছেন। আর এখন তিনি নিজেই গণহত্যায় অভিযুক্ত। ’ ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সিনেটর জন ম্যাককেইন গত মঙ্গলবার সু চিকে পাঠানো চিঠিতে ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট মোকাবেলায় দ্রুত মানবাধিকারের বাধ্যবাধকতা পূরণের আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমারে চলমান সহিংসতাকে তিনি ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, ‘এগুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। ’

ম্যাককেইন জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদকে রাখাইন অঞ্চলে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানান।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে গত মঙ্গলবার ঢাকায় ঝটিকা সফর করেছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি। রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়টি জাতিসংঘে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা নিয়ে গত রাতে বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় এসেছেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসগ্লু। জানা গেছে, আজ বৃহস্পতিবার তাঁরা কক্সবাজার এলাকায় গিয়ে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখবেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম তাঁদের সঙ্গে থাকবেন। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তুরস্কের ফার্স্ট লেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাতের কথা রয়েছে।

‘কৌশলী ভূমিকা’ : মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘাত এড়াতে ও রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে কৌশলী ভূমিকা নিয়েছে বাংলাদেশ। জানা গেছে, বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছে। মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন এবং দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের ভেতর রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ার প্রস্তাব আসছে বৈশ্বিক বিভিন্ন মহল থেকে। এ বিষয়ে বাংলাদেশেরও জোরালো সমর্থন রয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়া সম্ভব না হলে সেখানে অবস্থানরত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গার সবাই নিধনযজ্ঞের শিকার হতে বা প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হতে পারে।

এ পর্যন্ত ১৪ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছে বলে জানা যায়। তবে ভূমি দিয়ে আসা হাজার হাজার রোহিঙ্গা এখন নো ম্যানস ল্যান্ডে (দুই দেশের সীমান্ত রেখার মাঝামাঝি ৩০০ গজ) আশ্রয় নিয়েছে বলে বলে বিজিবি সূত্রে জানা গেছে। তাদের স্থানীয়রা ও বিভিন্ন এনজিওর কর্মীরা খাবার দিচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। ওই এলাকায় নারী ও শিশুদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছে পরিবেশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারে বিজিবির ৪৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মনজুর আহসান খান গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যাতে দেশের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যারা এসে পরে তাদের আমরা ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করি। এখন পর্যন্ত অনেককে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ব্যাটালিয়নের আওতায় মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ৫৩ কিলোমিটারের মতো। এর বেশির ভাগ এলাকাই দুর্গম। ’

শক্তিশালী বন্ধুদের দ্বারস্থ মিয়ানমার : রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের নির্মূল অভিযান থামার কোনো লক্ষণ নেই। উল্টো এ অভিযান বিষয়ে জাতিসংঘের ব্যবস্থা নেওয়া ঠেকাতে চীন ও রাশিয়ার মতো নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের দ্বারস্থ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থাউং তুনকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানায়।

থাউং তুন বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যু যাতে না ওঠে সে জন্য আমরা বন্ধুভাবাপন্ন কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা করেছি। চীন আমাদের বন্ধু এবং রাশিয়ার সঙ্গেও আমাদের একই ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তাই ইস্যুটিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। ’ সুত্র : কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেন আরও ৫৯ সেনা-বিজিপি সদস্য

আরাকান আর্মির হামলার মুখে ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্ত ফাঁড়ির ...